শিরোনাম :
সাপ্তাহিক আলোর মনি পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে আপনাকে স্বাগতম। # সারাবিশ্বের সর্বশেষ সংবাদ পড়তে আমাদের সঙ্গেই থাকুন। -ধন্যবাদ।
শিরোনাম :
বিএনপি সব সময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে: লালমনিরহাটে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু লালমনিরহাটে এলসিসিআই মডেল স্কুলের পাঠ সমাপনী ২০২৪খ্রি. অনুষ্ঠিত লালমনিরহাটে দিন দিন কমছে আখ চাষ লালমনিরহাটের শালবন হতে পারে পর্যটন কেন্দ্র লালমনিরহাটে মানব পাচার প্রতিরোধ কমিটির সদস্যদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কর্মশালা অনুষ্ঠিত লালমনিরহাট জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে নির্বাচিত হলেন যাঁরা! সার সিন্ডিকেট হোতারা ধোঁয়া ছোঁয়ার বাহিরে কেন লালমনিরহাটে তামাকের বিষে কমছে জমির ঊর্বরতা; বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি লালমনিরহাটে জেন্ডার-সংবেদনশীল দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসকরণ ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিযোজন বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত লালমনিরহাটে আত্মনির্ভরশীল দল এবং ইউডিএমসি এর মধ্যে অ্যাডভোকেসি এবং লবিং মিটিং অনুষ্ঠিত

আমার বাবা ডাঃ ওমর আলী ও কিছু কথা

সুলতানা শিরীন সাজি: ২৪ বছর পার হয়ে গেলো আজ। আব্বা চলে গেছেন ৯৭ এর ১৩ এপ্রিল। সেদিন বাংলাদেশে ক্রিকেট দল আইসিসিতে জিতেছিল। আব্বা চলে যাবার খবর পেয়ে দোয়েল, বানীরা ঢাকা থেকে লালমনিরহাট যাচ্ছিল যখন, গাড়ি থামিয়ে ওদেরকে রঙের পানি ঢেলে দিয়েছিল, পথে আনন্দ করতে থাকা পথচারীরা। ওদের কান্না সেদিন দেখতে পারেনি ওরা। আব্বা চলে যাওয়ার এতগুলো বছর চলে যাবার পর ও এখনো ঠিক মনে পড়ে শোনা সব কথাগুলো। আব্বা চলে যাবার খবর ফোনে জানিয়েছিল ভাইজান।মনে হয়েছিল কানের ভিতর আগুনের শিসা ঢেলে দিলো কেউ। অনেকদিন ফোনের রিং শুনলে ভয় হতো! দম আটকে আসতো। সেই শুরু। এরপর কত কাছের মানুষ চলে যাবার খবর পেলাম। সময়, অসময়ে কত মানুষ যে চলে গেলো। অবিশ্বাস্য মনে হলেও আজ আমার পাশের মানুষ, রাশীকের বাবাও নেই প্রায় ছয়মাস।

আব্বা চলে যাবার পর যখন খুব কাঁদতাম, ছোট্ট রাশীক আমাকে জড়িয়ে বলতো, “কেঁদোনা মামমা। আমিই তোমার বাবা ডাঃ ওমর আলী।”

 

আব্বাকে নিয়ে আমার স্মৃতির অন্ত নাই। আব্বা দূরে রোগী দেখতে যাবার সময় আমাকে সাথে নিয়ে যেতেন। মটর সাইকেলের পিছনে বসে আদিতমারী, কাকিনা যেতাম। ছোটবেলায় আব্বার সাথে বৈশাখ এর প্রথমদিন হালখাতা খেতে যেতাম। পুরান বাজারের মোড়ে আমাদের ঔষধের দোকান “সেবা ফার্মেসী”র আশে পাশে সব দোকানে হালখাতার সময় রঙিন কাগজ দিয়ে সাজাতো। আব্বার সাথে এক দোকান থেকে আর এক দোকান। গামলা ভর্তি মিস্টি দেখে আমার কেমন অবাক লাগতো। আব্বা টপাটপ অনেকগুলো রসগোল্লা খেয়ে ফেলতেন। লালশালু দিয়ে মোড়ানো খাতা নিয়ে বসে থাকতো দোকান মালিকরা। আমি খেতে পারতাম না একটার বেশি। নিমকী খেতে ভালো লাগতো খুব। ওটাই খেতাম। ওই রকম নিমকী আর দেখিনা কোথাও। এখন হাড়ি ভর্তি রসগোল্লা নিজেই বানাই, আব্বার কথা মনে হয়। কোনদিন কিছু রান্না করে খাওয়ানো হলোনা। আব্বা দেখে গেলেন না এসে এই দূর পরবাসে কেমন আছি।

 

আমি জন্মাবার পর আব্বা আমাকে বাঁচিয়ে তুলেছেন পরম মমতায়। একটা প্রীম্যাচিউর শিশুকে বড়করা অনেক কঠিন ছিল মায়ের জন্য। আব্বা সেই দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মা, আমার আপা, আপু আমাকে সারাজীবনে বহুবার বলেছে সেই গল্প। আব্বার সাথে আর দেখা হয়নি। আব্বা এয়ারপোর্টে এসেছিলেন। ছোট্ট একটা শিশুর মত কেঁদেছিলেন। হয়তো আর দেখা হবেনা বলেই। আব্বার সেই কান্নার জল এখন আমার চোখে। যতবার দেশে যাই, মনে হয় এয়ারপোর্টে নামলেই মনে হয় হয়তো আব্বাকে দেখতে পাবো। আব্বা বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই আমাকে নিতে আসতো!

 

আব্বা লেখাপড়া ভালোবাসতেন। শুধু চাইতেন আমরা অনেক লেখাপড়া করি। আব্বার ছাত্র জীবনে অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করেছিলেন কিন্তু আমাদের কোন অভাব বুঝতে দেননি। আমাদের বাসায় কখনো আমরা বুঝিনি আমরা মেয়ে তাই এটা করা যাবেনা, ওটা করা যাবেনা। আব্বা সব সময় চেয়েছেন আমরা যেনো লেখাপড়া করে ভালো মানুষ হই। আব্বা অসম্ভব উচ্চাভিলাষী একজন মানুষ ছিলেন। আব্বা মায়ের মনের স্বপ্ন দিয়ে গড়া আমরা তাদের ছেলে মেয়েরা। আমি বিশ্বাস করি আমাদের সব ভালোতে তারা আছেন। দেশে গিয়ে লালমনিরহাটে  ভাবীর নামে নামকরণ করা, ডাঃ সেলিমা রহমান ডায়েবেটিক হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল, আব্বার স্বপ্নগুলো ভাইজান, ভাবীর মত কত অজস্র স্বপ্নচারী মানুষদের হাত ছুঁয়ে কত দূর চলে গেছে। এতবড় একটা প্রতিষ্ঠান, কত মানুষের অক্লান্ত সাধনায় তৈরী হয়েছে। আব্বা দেখতে পারলে অনেক খুশি হতেন। আর দেখছেন যে না তাই বা কি করে বলি!

 

অনেক দিন হলো অদৃশ্য অথচ ভয়ংকর ভাইরাস থেকে দূরে থাকতে ঘরে আছি সবাই। রাশীকের বাবার জন্য গতবছর কত যে টেনশন করেছি সবাই। এখন, ও নেই। সব কেমন হয়ে গেছে। কোভিডের জন্য কি ভীষন ভয় পেতো সে। হাসপাতালে যেতে চাইতোনা।

 

লকডাউনে এখন বেশির ভাগ বাজার, রাশীক আর বাসমাহ করে। আমিও মাঝে মাঝে যাই। এখন কেউ আর বাসায় আসেনা। কারো সাথে কোথাও দেখা হয়না।  কয়েকদিন আগে বন্ধুদের অনেককে লিখেছি, আমার ভীষন কাঁদতে ইচ্ছে করে। মনে হয় কাউকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদি। বাচ্চাদের সামনে কাঁদলে ওরা অস্থির হয়ে যায়। রাশীক, রাইয়ানের  কান্নাভেজা চোখ দেখি প্রায়। আমরা সবাই সবাইকে লুকাই। আবার কখনো লুকাতে পারিনা। এক সাথে জড়িয়ে কাঁদি। বাবা মা না থাকলে জীবন শূন্য হয়ে যায়। রাশীক, রাইয়ান আর বাসমাহ সেটা বুঝছে। আজ ওদের বলছিলাম, আব্বা নেই ২৪বছর। ওরা আব্বাকে দেখেনি। নানা ওদের কাছে শুধু একটা সম্পর্কের নাম। আজ প্রথম রোজার  ইফতারের পর সবাই একসাথে নামাজ পড়ে দোয়া করলাম।

 

এত বছর পার হয়ে গেলো। এখনো দেশে গেলে মনে হয় একবার যদি আব্বা এসে দাঁড়াতেন। দেশ ছেড়ে আসার আগে আব্বার সেই কান্না ভেজা মুখ। অবিরল চোখের জল। চোখ ভেসে যায় আমারো। দেখা হয়না আর। খুঁজে পাইনা আর সেই অদ্ভুত ভালোবাসার মানুষ। দিনের পর দিন কেটে যায়।

কিছু দিন জীবনে আসে। কেমন ফাঁকা ফাঁকা অনুভব হয়। আজ এমনি একটা দিন। শূন্য লাগে সব। রাশীকের বাবা থাকলে বলতো, মা বাবাতো আমারো নাই সাজি। চোখ মুছিয়ে দেবার, বুঝতে পারার সেই মানুষটা আজ কোন সে আসমানে? কতদূরে গেলে আবার তাদের পাবো?

 

আমার রাশীক, রাইয়ানের দিকে তাকালে কারো চোখ, কারো ঠোঁট, কারো হাতের, মুখের দিকে তাকালে আব্বার মত লাগে। কখনো কখনো ভাইজানের মত, বোনদের মতো এমনকি নিজের মত  লাগে। রাশীকের হাঁচির শব্দ শুনলে আব্বাকে মনে পড়ে। ওদের জড়িয়ে থাকি। ওদের জড়িয়ে বাঁচি। আব্বা আব্বা বলে ওদেরই ডাকি।

প্রার্থনা করি, আব্বার আত্মা শান্তিতে থাক। চলে যাওয়া প্রিয় মানুষদের জন্য আমাদের সবার তো এই একই প্রার্থনা।

“রাব্বির হাম-হুমা কামা রাব্বা ইয়ানি ছাগিরা।”

“হে আমার প্রতিপালক! আমার পিতা-মাতার প্রতি দয়া করো, যেমন তারা দয়া, মায়া, মমতা সহকারে শৈশবে আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন।”

 

১৩ এপ্রিল/২০২১

অটোয়া

সংবাদটি শেয়ার করুন




এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা ও ছবি অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি
Design & Developed by Freelancer Zone